বিহারে গঙ্গা অববাহিকায় বন্যার ছবি। ছবি : বিবিসি
ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার ৪৩ বছরের মাথায় সেটিকে ভেঙে ফেলার দাবি উঠছে খোদ ভারতেই। মূলত যে কারণে ফারাক্কা বাঁধ দেয়া হয়, সেই উপকার তো পাননি উল্টো এই বাঁধের কারণে পলি জমে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে ওই দেশটির অঞ্চলের মানুষজন।
১৯৬১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদাহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। আর এ মরণ ফাঁদের বাঁধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে লংমার্চ করেছিলেন বাংলাদেশর মানুষ। দিনটি ছিলো ১৬ মে, এই ঐতিহাসিক দিন উপলক্ষে এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসি।
এরপর থেকেই এ দিনটি 'ফারাক্কা লং মার্চ দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে, যদিও বিগত পাঁচ দশকে ফারাক্কা নিয়ে ভারতের অবস্থানে কোনো বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতেও ফারাক্কার বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তো ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলারও প্রস্তাব করেছেন।
দেশটির অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকর ও অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভারতেও ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে। কাজেই এটি অবিলম্বে 'ডিকমিশন (ধ্বংসকরণ)' করা দরকার। ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর পর থেকেই বিতর্ক কখনোই এই প্রকল্পটির পিছু ছাড়েনি।
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের যেমন মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তেমনি ভারতেও কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফারাক্কা নানা ধরনের বিপদ ডেকে এনেছে।
বিহার প্রদেশের গঙ্গ নদীর অববাহিকায় প্রতি বছরের ভয়াবহ বন্যার জন্য ফারাক্কাকেই দায়ী করে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এই বাঁধটাই তুলে দিতে বলেছিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারকে।
গঙ্গার ভাঙনে কীভাবে ভিটে হারিয়েছেন সেটা দেখাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা উর্মিলা দাস। ছবি: বিবিসি
ভারতে নামী সংরক্ষণ অ্যাক্টিভিস্ট ও নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকর বলেন, ‘একটা বাঁধের প্রভাব যদি খুব ধ্বংসাত্মক হয়, ফারাক্কাতে যেটা হয়েছে, তাহলে সেটা ডিকমিশন করার অসংখ্য নজির কিন্তু দুনিয়াতে আছে। আমেরিকাতেও শতাধিক ড্যাম ভেঙে দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নীতিশ কুমার ফারাক্কা ভাঙার প্রস্তাব দিলেও সে ব্যাপারে বিশেষ কিছু করেননি, সত্যিকারের সোশ্যালিস্ট রাজনীতিতে বিশ্বাস করলে তারও এতদিনে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেয়া উচিত ছিল।’
ভারতের সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপলের কর্ণধার ও নদী-বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠক্কর জানান, একটা বাঁধ ডিকমিশন করার আগে কয়েকটা জিনিস খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, দেখতে হয় লাভ-ক্ষতির পাল্লাটা কোন দিকে ভারী।
তিনি আরো বলেন, ‘ফারাক্কার ক্ষেত্রে সেই স্টাডিটা এখনও শুরু করা হয়নি। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট, ফারাক্কার মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল সেই কলকাতা বন্দরকে কিন্তু আজও বাঁচানো যায়নি। কলকাতা বন্দর টিঁকিয়ে রাখতে আজ যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয়, ফারাক্কা চালু হওয়ার আগেও ততটা করতে হত না। এটাকে একটা প্রতীক ধরলে ফারাক্কা তো ভেঙে ফেলাই উচিত।’
হিমাংশু আরো জানান, ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর রেল ও সড়ক-সেতু এখনকার মতো রেখে দিয়েই ব্যারাজটা সরিয়ে দেয়া সম্ভব। ইউরোপ আমেরিকার অনেক জায়গাতেই তা হয়েছে।
এ বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ সুমনা ব্যানার্জি বলেন, ‘ফারাক্কার জন্য গঙ্গায় এত বেশি পলি জমছে যে তাতে দুপারের জমি ভাঙছে, জনপদ প্লাবিত হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, প্রতি বছরই আমরা ফিল্ড ট্রিপে সেখানে যাই। পাঁচ- ছয় বছর আগে যখন মালদার পঞ্চানন্দপুরের ভাঙন খতিয়ে দেখতে যাই, তখন দেখেছিলাম ফারাক্কার বুকে মাঝগঙ্গাতেও কিন্তু বক দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিটাই বলে দেয় গঙ্গাতে কী পরিমাণ সিল্টেশন জমছে বা সেডিমেন্টেশন হচ্ছে। আর সেই সিল্টেশন ঠেকানোর ক্ষমতা যদি ফারাক্কার না-থাকে, তাহলে তো গোটা ব্যারাজটাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়, তাই না?’
অধ্যাপক সুমনা ব্যানার্জি আরো বলেন, ‘আমরা ফারাক্কাকে এই অবস্থাতেই ফেলে রেখেছি যেখানে এত বিপুল পরিমাণ সেডিমেন্টেশন হচ্ছে যে নদীর চ্যানেলটার আর পানি ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। আর সেটা দুপারে উপছে পড়ছে।
স্থানীয় একজন গ্রামবাসী সুন্দর উপমা টেনে এ অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘সাপের মুখটা জোরে ধরে রাখলে সাপটা যেমন ছটফট করে, নদীটাও এখানে সেভাবে ছটফট করছে। আর সাপের মুখটা ধরে রাখা হচ্ছে এই ফারাক্কা ব্যারাজ!’
মেধা পাটকর জানান, কোনো সংশয় নেই, ভারতের জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে।
তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘না ভাটিতে, না উজানে। ফারাক্কার প্রভাব কোথাও সুখকর হয়নি। বলা হয়েছিল ফারাক্কা বন্যা রুখতে পারবে, অথচ দেখা গেছে বন্যা আর খরার চক্র ঘুরেফিরে এসেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ফারাক্কার অভিজ্ঞতা আমাদের এটাই শিখিয়েছে যে বড় নদীর বুকে পানি নিয়ে খেলতে নেই। তুমি বরং সেই পানিটাকে ক্যাচমেন্টে আটকাতে পারো, বড় নদীতে মেশার আগেই সেই পানিটা কাজে লাগিয়ে নিতে পারো।’
ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞই খোলাখুলি ভাবে বলছেন যে, প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো ফারাক্কা ব্যারাজ যে ভারতের আর বিশেষ কোনো কাজে আসছে না, বরং নানা ধরনের পরিবেশগত বিপদ ডেকে আনছে।
তবে ফারাক্কা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনৈতিক স্তরেই, বছর তিনেক আগে নীতীশ কুমারের প্রকাশ্য দাবির পরেও সে কাজে কিন্তু খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
বাংলা/এনএস