ছবি : সংগৃহীত
কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। ইয়াবা কারবারের সাথে যে নামটি বারবার উঠে এসেছে। তবে যার বিরুদ্ধে এতো বড় অভিযোগ লেগেই আছে সে ব্যক্তিটি নিজ এলাকায় দেদারছে দান খয়রাত করে চলেছেন। গত কয়েক বছর ধরে বদি বছরে কেবল ১৯ কোটি টাকার মতো খরচ করেন চাল বিতরণে।
প্রতিমাসে ৫৬ হাজার মানুষের মাঝে বিনামূল্যে চাল বিতরণ করেন তিনি। এছাড়া চিনি, দুধ, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডাল এবং ছোলাও বিতরণ করেন রমজান মাসে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিপুল পরিমাণ মানুষ আর্থিক সহায়তাও পান তার কাছে।
সোমবার এসব তথ্য সম্বলিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার।
২০১৬ সাল থেকে বদি এ ধরনের দান খয়রাত করা শুরু করেছেন। অথচ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি তার বার্ষিক আয় উল্লেখ করেন ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। প্রশ্ন উঠেছে, বদি তার আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ কীভাবে বিতরণ করেন?
টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলম বাহাদূর বলেন, ‘২০১৬ সালে বদি তার নির্বাচনী এলাকায় দরিদ্র মানুষদের একটি তালিকা তৈরি করেন টেকনাফ পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে। প্রত্যেককে একটি কার্ড দেওয়া হয় এবং তাদেরকে ১০ কেজি করে আতপ চাল বিতরণ শুরু হয়।
তিনি জানান, টেকনাফ সদর ইউনিয়নে সাত হাজার হোয়াইকং ইউনিয়নে ১৩ হাজার, হ্নীলা ইউনিয়নে ১১ হাজার, বাহারছড়ায় নয় হাজার, সাবরাং ইউনিয়নে পাঁচ হাজার এবং শাহপরী দ্বীপেও কয়েক হাজার মানুষ তালিকাবদ্ধ হয়।
এই কার্ডে এক পাশে লেখা আছে, ‘বদি ভাইয়ের সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন। অন্য পাশে আছে বদির ছবি।
কক্সবাজার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জাফর আলম চৌধুরীও নিশ্চিত করেছেন যে, ৫৬ হাজারের মতো মানুষ গত তিন বছর ধরে বিনামূল্যে চাল পেয়ে আসছে।
যারা চাল পেয়ে আসছেন, তারা জানান, আপত চালের মান খুবই ভালো এবং এর দাম ২৮ থেকে ৩০ টাকা।
এই হিসাবে বদি মাসে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কেজি চাল বিতরণ করেন আর এর দাম হয় বছরে এক কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আর বছরে টাকার অংক দাঁড়ায় ১৯ কোটি টাকা।
এর বাইরেও স্থানীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতেও বদি একশ থেকে এক হাজার টাকার নোট বিতরণ করেন, যার কোনো হিসাব নেই। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে তিনি রাজনীতিক বা সাবেক আইন প্রণেতার চেয়ে দানবীর হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
টেকনাফের সালামপুর হাইস্কুলের কাছে একটি চায়ের দোকানে বদির বিষয়ে কথা বলার সময় ৫৫ বছর বয়সী এক নারী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তিনি বলেন, ‘আপনি এখান থেকে ভাগেন। আপনার কোনো অধিকার নেই বদি ভাইকে নিয়ে কথা বলার। গত ৫০ বছরে তার মতো আর কেউ আমাদের উপকার করেনি।’
এই নারীর মতোই আরো পাঁচ থেকে ছয় জন একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানালেন।
বদি স্থানীয় একটি কলেজ, একটি হাইস্কুল এবং একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জানুয়ারি মাসে চাল বিতরণের সময় বদি বলেছিলেন, ‘আমি আমার ব্যবসার ৭০ শতাংশ আয় মানুষের মধ্যে বিতরণ করি। এর সব কৃতিত্ব এলাকার মানুষের।’
তবে বদি তার ব্যবসার ধরণ আর তা কত বড় এবং তিনি কত টাকা দান করেন, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বদি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সংসদ সদস্য হওয়ার পর আমদানি-রপ্তানির সেবা দানকারী সিএন্ডএফ এজেন্সি নিয়ন্ত্রণ করেন।
বদির নিজেরও চারটি এজেন্সি রয়েছে। এগুলো হলো: মেসার্স এ রহমান এজেন্সি (নিজের নামে), মেসার্স সামিয়া এন্টারপ্রাইজ (তার মেয়ের নামে), মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ (ছেলের নামে) এবং মেসার্স শাহীন অ্যান্ড সন্স (পুত্রবধূর নামে)।
টেকনাফের চৌধুরীপাড়া এলাকায় একটি টিনশেড ভবনে এই চারটি এজেন্সির অফিস রয়েছে। এর সাইনবোর্ডে মালিক হিসেবে আবদুর রহমান বদির নাম উল্লেখ আছে।
সূত্র বলছে, এই চারটি এজেন্সির মাধ্যমে বদি মিয়ানমার থেকে মাছ, আচার, কাঠ, আদা আমদানি করেন আর সেখানে রপ্তানি করেন শুঁকটি মাছ। দেশটির সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। তার দাদা সুলতান আহমেদ মিয়ানমারে থাকতেন।
স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বদি মিয়ানমার থেকে বার্মাটিক সেগুনের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক আর এ থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করেন। এটা তার আয়ের অন্যতম উৎস।
সাবেক আইনপ্রণেতা টেকনাফের একটি আবাসিক হোটেল এবং বেশ কিছু দোকানও প্রতিষ্ঠা করেছেন।
চারতলা নাফ হোটেল অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যে পারিবারিক বাসভবনে পরিণত হয়। এর দুই থেকে তিনটি কক্ষ মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়।
কক্সবাজার ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিসের সূত্র বলছে, বদি, তার স্ত্রী, বোন এবং ভাইদের নামে টেকনাফ, উখিয়া, ইনানী, বাহারছত্র এবং সেন্ট মার্টিনে বিপুল জমিরও মালিক।
গত কয়েক বছর ধরেই বদি কক্সবাজারের সর্বোচ্চ করদাতা বলে জানাচ্ছে জেলা আয়কর অফিস।
অভিযোগ আছে, বদি তার প্রকাশ্য ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা পাচারে জড়িত। আর তার সম্পদের একটি বড় অংশই আসে মিয়ানমার থেকে এই মাদক এনে। গত কয়েক বছর ধরে বহুবার এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বদিকে মাদকের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে একাধিকবার।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়াবার অন্য বড় পাচারকারী বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বদির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করতে পারবেন না।
এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ইয়াবা পাচার বন্ধে বদির ইচ্ছাই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী বদির ভাই মুজিবুর রহমান ও আবদুল শুক্কুর এবং চাচাতো ভাই মং মং সেনও ইয়াবার গডফাদার।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারে ইয়াবার ১২০ জন তালিকাভুক্ত পাচারকারী আছে। আর সবার আগে নাম আছে বদির।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৪৬ কোটি ইয়াবার বড়ি পাচার হয়ে আসে। একেকটি বড়ি আড়াইশ টাকা করে বিক্রি হয়। এই হিসাবে এই কারবার অন্তত ১১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার।
গত বছর পুলিশ, র্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিজিবি এবং অন্যান্য সংস্থা মিলিয়ে তিন কোটি ৬৯ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছে।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, তারা ইয়াবা কারবারে বদির সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য পাননি।
বদি বর্তমানে কক্সবাজার আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য হলেও ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পরে ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান।
ওই বছর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় বদি জানান, তিনি বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে বছরে এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে ৯১ হাজার ৯৮ টাকা এবং ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা আয় করেন লবণ মাঠ থেকে। অর্থাৎ তার বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার কম ছিল সে সময়। সে সময় তিনি জানান, তার ওপর নির্ভরশীলরা বছরে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা আয় করেন।
তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বদি জানান, তিনি কৃষি থেকে চার হাজার ৬৫০ টাকা, বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া থেকে দুই কোটি আট লাখ, ব্যবসা থেকে পাঁচ কোটি ৩২ লাখ, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে আট কোটি পাঁচ লাখ এবং লবণের মাঠ থেকে ৯১ হাজার টাকা আয় করেন বছরে।
এই হিসাবে তখন বদির বছরে আয় দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
এদিকে এমন বিতর্কের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বদিকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। তবে তার স্ত্রী শাহীন আক্তার পান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। এবং নির্বাচনে জয়ী হন।
এদিকে ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারের পক্ষ থেকে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ করতে বললে কক্সবাজারে ৬৩ জন সন্দেহভাজন ইয়াবা কারবারি ও গডফাদার আত্মসর্ম্পণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন।
এদের মধ্যে বদির তিন ভাইসহ বেশ কয়েকজন আত্মীয় রয়েছেন।